ইয়াহিয়া নয়ন:
অবৈধ ব্যবসা, চাঁদাবাজি আর নানা রকম অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে যুবলীগের নেতাকর্মীরা। যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা সংগঠনটি সম্পর্কে এ মূল্যায়ন তুলে ধরেন। তারা জানান, যুবলীগে শুদ্ধি অভিযান চালানোর পরপরই স্থবির হয়ে পড়েছে সংগঠনটির সব ধরনের কার্যক্রম। বিশেষ করে রাজধানীতে তাদের কোন কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি গত কয়েক দিন। যুবলীগ নিয়ে দলীয় প্রধানের সমালোচনার পর থেকে যুবলীগের নেতাকর্মীদের সংগঠনটির বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কার্যালয়ের আশপাশে উপস্থিতি কমে গেছে। দলীয় নেতারা বলেন, সম্প্রতি অভিযান সম্পর্কে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী যে মন্তব্য করেছেন, তা সংগঠনটিকে আরা বিতর্কিত করেছে। কারণ তার মন্তব্য ছিলো সরাসরি দলীয় সভাপতিকে ঘিরে।
যুবলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা চেয়ারম্যানের ওই বক্তব্য ভালোভাবে নিতে পারেননি। এ নিয়ে সংগঠনটির মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ যুবলীগের কয়েকজন নেতা এরইমধ্যে যুবলীগ চেয়ারম্যানকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সংগঠনটির মধ্যম সারির এক নেতা জানান, চেয়ারম্যানের ওই ধরনের বক্তব্যের পর সাহস করে তাকে কুল থাকার পরামর্শ দিয়েছি। তিনি কিভাবে নিয়েছেন জানি না তবে সংগঠনের স্বার্থে তাকে ওই পরামর্শ দিয়েছি। এদিকে, রাজধানীতে আপাতত সব ধরনের কর্মসূচি থেকে বিরত রয়েছে যুবলীগ। গত তিন দিনে যুবলীগের কয়েকটি পূর্ব র্নিধারিত কর্মসূচি ছিলো রাজধানীতে। সেসব কর্মসূচিতে যুবলীগ চেয়ারম্যানের উপস্থিত থাকার কথা ছিলো। কিন্তু অনিবার্য কারণে সেসব কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন যুবলীগের মধ্যম সারির কয়েকজন নেতা। তারা বলেন, আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। একারণে কর্মসূচি পালন থেকে বিরত থাকা হচ্ছে। নেতা-কর্মীরা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরই যুবলীগের কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। তাই কমিটি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তারা জানান, আমরা এখন অপেক্ষায় আছি প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার দিকে। তিনি এসে কি পদক্ষেপ নেন বা কি ধরনের নির্দেশনা দেন তার জন্য চেয়ে রয়েছি। এদিকে, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিয়ে আত্মবিচার করতে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুবলীগ। এ নিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেয়া হয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়েছেন। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিষয়টি নজিরবিহীন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ক্ষোভের কথা শুনে সংগঠনের অভিযোগবিদ্ধ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এ উদ্যোগ নেয় যুবলীগ। যুবলীগ ট্রাইব্যুনালের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। তবে ট্রাইব্যুনালের কোন কার্যক্রম আপাতত নেই বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। এখন পর্যন্ত কেউই যুবলীগের কোন নেতার বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণসহ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা দেননি।
পত্রিকায় দেয়া বিজ্ঞাপনে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদকের ফোন নম্বর দেয়া হলেও ওই নাম্বারে ফোন ধরছেন না বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন নেতা। অভিযোগ রয়েছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যর্থতায় কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় অনেক নেতা সন্ত্রাস দুর্নীতিতে জড়িয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অনেকে উদাহরণ এনে বলছেন, সংগঠনের অফিস পিয়ন থেকে দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়া কাজী আনিসুর রহমান কয়েক বছরে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন। এই অর্থের বড় অংশ আসে কমিটি বাণিজ্যের মাধ্যমে। অর্থের মাধ্যমে এমন অনেককে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা কমিটিতে স্থান দেয়া হয়েছে যারা চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত। কাজী আনিস যুবলীগ চেয়ারম্যানের ঘনিষ্টজন। এমন বাণিজ্যের দায় তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। এমন বাণিজ্যের কারণে ঐহিত্যবাহী সংগঠনটি তার রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়েছে। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ক্যাসিনো ডন খালেদ মাহমুদ ভূইয়া ও টেন্ডার মুঘল জি কে শামীমও সব অপকর্ম করে বেড়াতেন সংগঠনের পরিচয়ে। এছাড়া যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতির বিরুদ্ধে এখন নানা অভিযোগের তীর।
সাংগঠনিক কর্মসূচির বিষয়ে জানতে সংগঠনটির সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তারা ফোন ধরেননি। ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সভাপতি মইনুল হোসেন খান নিখিল বলেন, সংগঠনের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারনেই আজকে যুবলীগের এই অবস্থা। আমি মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেও সংকোচ বোধ করছি। মনে হয় মানুষ যেনো বলছে এই যে ক্যাসিনো ব্যবসায়ি আসছে। এই কষ্ট আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুবলীগে যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন আমি সেটাকে সাধুবাদ জানাই। পূর্ন সমর্থন জানাই। তিনি বলেন, তিনটি শ্রেণীর মানুষ রাজনীতি করে। এদের মধ্যে কেউ আসে দলের আদর্শকে ভালোবেসে, কেউ আসে জনগণের স্বার্থে কাজ করতে আর কেউ আসে নিজের আখের গোছাতে। যাদের বিরুদ্ধে এখন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তারা দলে এসেছিলো আখের গোছাতে। এজন্য তারা দলের এতবড় ক্ষতি করতে পেরেছে। আপনার গণভবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ ও বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে-এমন খবর মিডিয়ায় এসেছে। এমন প্রশ্নে নিখিল বলেন,আমি এমন কোন কাজ করিনি যে গণভবনে প্রবেশ করতে কিংবা বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে। এরকম কিছু হলে অন্তত আমি তো জানতাম। আমি বরাবরই স্বচ্ছ রাজনীতি করি। মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করি। সততার মাধ্যমে নিজেকে পরিচালনার চেষ্টা করি। এখন অনেকেই বিভিন্নভাবে আমার ছবি সামনে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এসব কেন করছেন আমি জানি না। গোয়েন্দা সংস্থা আছে, দেশপ্রেমিক সাংবাদিকরা আছেন, আমার সম্পর্কে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যদি মনে করেন আমি অপরাধী বা কোন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে তাহলে সেটা আপনারা প্রকাশ করুন। এতে আমার কোন আপত্তি নেই। ১৪ই সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ছাত্রলীগের পাশাপাশি যুবলীগের কতিপয় নেতার কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা মহানগর যুবলীগের একাধিক প্রভাবশালী নেতাকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরা শোভন-রাব্বানীর (ছাত্রলীগ থেকে অপসারিত দুই শীর্ষ নেতা) চেয়েও খারাপ। এরা তো জন্মদিন (শেখ হাসিনার) পালনের নামে চাঁদাবাজি করতে পারে, এমনভাবে আমার জন্মদিন পালনের দরকার নেই। যুবলীগের কিছু নেতার বিরুদ্ধে উচ্ছৃঙ্খল আচরণের অভিযোগ আমার কাছে আছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও বেপরোয়া চলাচল বরদাশত করা হবে না। ২০১২ সালে ষষ্ঠ কংগ্রেসের মাধ্যমে যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান ওমর ফারুক চৌধুরী ও হারুনুর রশীদ। ১৪৮ সদস্যর কেন্দ্রীয় কমিটিতে চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও ২৬ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য, ৫ জন যুগ্ম সম্পাদক, ৭ জন সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৫ জন সম্পাদক, ৩৫ জন উপ-সম্পাদক, ২০ জন সহ-সম্পাদক এবং ২৬ জন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রয়েছেন।
লেখক :সাংবাদিক,কলাম লেখক।